সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

"টুনটুনির বই আসলে পশুপক্ষীর আড়ালে মানুষের কথা" । – আলোচনা করো।

উত্তর : 

      টুনটুনির বই গল্পে মোট ২৭ টি গল্প আছে প্রতিটি গল্পের মূল চরিত্র হলে পশু-পাখি কীট-পতঙ্গ সরিসৃপ আবার কখনও বা মানুষ। তারা সবাই একে অপরের ভাষা বোঝে মানুষের মত কথা কয় মানুষেরসঙ্গে কথা বলে।

প্রসঙ্গত বলতে হয় রূপকথা উপকথা প্রভৃতি সাহিত্য শুধু কল্পনা মাত্র নয় সেখানে আছে বাস্তবতা। কেননা বাস্তবতা ছাড়া কোন সাহিত্যই হয় না। রূপকথার থাকে বাস্তবকে অবলম্বন করে সুদুরপ্রসারী কল্পনার বিস্তার আর উপকথায় থাকে পশু পাখি প্রভৃতি মনুষ্যত্বের গল্প কাহিনীর রুপাকে মানুষের জীবনের বাস্তব চরিত্রাঙ্কন।

উপেন্দ্রকিশোর টুনটুনির বই লিখতে গিয়ে শিশু শিক্ষার আসর ফাঁদেন নি। তাদের নির্ভেজাল আনন্দ দেওয়ার জন্য অবাস্তবকে রসের মোড়কে ও কতকথার গুণে প্রায় দৃশ্যমান বাস্ত । মতো করে পরিবেশন করে শিশুদের বিস্ময়ে আবিষ্ট করে তোলার জন্য একের পর এক গল্পগুলো লিখে গেছেন তাতে নীতি শিক্ষা বিশেষ নেই।

টুটুনির বই-এর বিশেষত্ব হলো শক্তি বা কলেবরে বিরাটত্বের জয় নয় বুদ্ধির প্রখরতায় প্রতুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা বিপদ মুক্ত হওয়া যায়। শক্তির মদ মত্ততায় অহংকারী হয়ে উঠলে তার পরাজয় বা পতন অবশ্যম্ভাবীই। ক্ষুদ্র প্রাণী শিয়ালের মাধ্যমে বাঘ ও সিংহের পরাজয় দেখিয়ে লেখক উপেন্দ্রকিশোর যেন সমকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকের পরিণতির ইঙ্গিত ব্যঞ্ছিত করেছেন। লেখক শিয়াল ছাগল ছানা পিঁপড়ে প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণীর বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা বিরাট শক্তির পতন বা মহৎ কার্যসিদ্ধি দেখিয়েছেন একই ভাবে মশার মতো অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে বিরাট শক্তির পতন এবং মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধি দেখিয়েছেন।

মানব চরিত্র বড় বিচিত্র। কেউ ধূর্ত কেউ অকারণ আনন্দ পেতেন অন্যের ক্ষতি সাধন করে। কেউ আবার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে-কোনো মিথ্যাচারের পথ অবলম্বন করতে পারে কেউ বা দুর্বল হলেও বুদ্ধির জোরে তার থেকেও শক্তিশালী বা ক্ষমতা সম্পন্নকেও হারিয়ে দিতে পারে। কেউ বা আবার দোষীকে শাস্তি দিতে পারে। কেউ-বা নিজের মুর্খামিতে শাস্তি পায়। এমন মানব চরিত্র নির্ভর বৈশিষ্ট্যগুলি চিত্রায়িত হয়েছে টুনটুনির বই -এর বিভিন্ন গল্পের মধ্যে।

উপেন্দ্রকিশোর গল্পগুলি কিন্তু নিজের থেকে বানাননি লোক কথার ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করেছেন। শিশু মন ভোলানোর জন্য এই গল্পগুলি মুখে মুখে প্রচারিত হতো। লেখক এর উদ্দেশ্য ছিল শিশু মনোরঞ্জন। এর সঙ্গে উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের নির্যাতনের কথা রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা। এসবের মধ্যেই পরাধীন ভারতবর্ষে লেখকের স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতা প্রত্যাগী মানসিকতা অবশ্যই ব্যঞ্ছিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে লেখখ ক্ষুদ্র প্রাণীর এমন মহৎ দিক দেখালেন কেন আসলে প্রবল ইংরেজের অপ্রতিরোধ্য শাসনকালে পরাধীন ভারতীয়রা তখন অতি তুচ্ছ ও দুর্বল শক্তিহীন ছিল। লেখক দেখাতে চেয়েছেন মনের জোর বা শক্তি অর্থাৎ আত্মপ্রত্যয় এবং বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যদি থাকে তাহলে ইংরেজির মত প্রবল শক্তি বা সেই রকম কোন অন্য শক্তি রাষ্ট্রীক বা সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে বিনাশ হতে পারে মানুষের এবং বিশেষত ভারতের মনে সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষুদ্র প্রাণীর মাধ্যমে জয় দেখিয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন মানুষ কম শক্তিমান বা দুর্বল বা ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নগণ্য নয়। তারও বিরাট ভূমিকা আছে তাদের বুদ্ধি বা ঐক্যবদ্ধতা বিরাট কার্যসিদ্ধি বা উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়।

লেখক পশুপাখির মধ্য দিয়ে মানব সমাজের মানুষের বিভিন্ন চরিত্র বৈশিষ্ট্য রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যেমন অতি চালাকি ভালো নয় তা পরাজয় ডেকে আনে। লেখক দেখিয়েছেন শিয়াল ও বুদ্ধিমান এবং চালাক চতুর। ধূর্ত কৌশলে বুদ্ধির জোরে সে জয়ী হয়েছে আবার ধূর্ততার আতিশয্যে সে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়েছে। এভাবে বাংলাদেশের লোক কথার মধ্য দিয়ে নরহরি দাস, কুজো বুড়ির কথা, আখের ফল প্রভৃতি গল্পে লেখক ও পশু কথার মধ্য দিয়ে মানবকথা পরিস্ফুট করেছেন। টুনটুনি আর বিড়ালের কথা, মজন্তালি সরকার গল্প বিড়ালের করুণ পরিণতিতে লেখক ধূর্ততার পরাজয় দেখিয়েছেন। অর্থাৎ লেখক মানুষের ধূর্ততার না বুদ্ধির ও প্রতুপন্ন মতিত্বের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন টুনটুনির বই নানা গল্পে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপ আলোচনা করো।

  ★ধর্মমঙ্গলের কাহিনি:– ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি—হরিশ্চন্দ্র ও লাউসেনের কাহিনি।   ১. হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি:– রাজা হরিশ্চন্দ্র ও তার রানি মদনা নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজে লোকনিন্দার ভয়ে মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখেন সেখানে ধর্মঠাকুরের ভক্তেরা ঘটা করে দেবতার পূজা করছেন। রাজা ও রানি তাদের কাছে ধর্মঠাকুরের। মাহাত্ম্য শুনে ধর্মঠাকুরের পূজার্চনা করে শর্তসাপেক্ষে বর লাভ করেন। শর্ত হল এই তাদের পুত্রকে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দিতে হবে। যথাসময়ে মদনার পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাজা ও রানি পুত্রকে পেয়ে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দেওয়ার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদিন হরিশ্চন্দ্রের কাছে উপস্থিত হন। সেদিন ছিল। একাদশীর পারণ; ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র লুইধরের মাংস আহার করতে চাইলে রাজা ও রানি পুত্রকে বধ করে তার মাংস রান্না করলেন। রাজা ও রানির এই আনুগত্য ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মঠাকুর লুইধরকে জীবিত করে পুনরায় রাজা-রানির কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাজা ও রানির প্রচেষ্টায় ধর্মঠাকুরের পূজা মহাসমারোহে আয়োজিত হতে থাকে। ২. লাউসেনের কাহিনি:...

ধর্মমঙ্গল কাব্যের অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দাও।।।।

         ■ অষ্টাদশ শতাব্দী – শ্রেষ্ঠ কবি                    • ঘনরাম চক্রবর্তী ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম অষ্টাদশ শতাব্দীর শক্তিমান কবি। মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্যযুগের শেষ পর্যায়ে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল এবং ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল নির্বাণোন্মুখ দীপশিখার মতো সর্বশেষ জ্যোতি।  সুকুমার সেন লিখেছেন,– “ধর্মমঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত ও দক্ষ ছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম সুলেখক ছিলেন। তাঁহার রচনা সর্বাধিক পরিচিত ধর্মমঙ্গল কাব্য”। ( বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫১ )।  অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন, –“আধুনিক যুগের বাঙালী সমাজ তাঁহার কাব্য হইতেই ধর্মমঙ্গল কাব্যের নূতনত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন। এই শাখার অন্যান্য শক্তিশালী কবি অপেক্ষা ঘনরাম অধিকতর ভাগ্যবান। কারণ ধর্মমঙ্গলের কবিদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মার্জিত রুচির নাগরিক সমাজে পরিচিত হন। ( বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-৯৮ ...

বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা এবং বিবর্তনের ইতিহাস। সমস্ত সংক্ষিপ্ত ও অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ....

সংক্ষিপ্ত ও অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ....                                                  প্রতিটি প্রশ্নের মান ১/২ 1. ভারতবর্ষের প্রথম সাহিত্যিক ভাষারূপে কোন ভাষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে? উত্তর : আনুমানিক খ্রিঃ পূর্বঃ ৬০০-২০০ খ্রিঃ মধ্যে প্রচলিত 'পালি' ভাষাকে লোক ভারতের প্রথম সাহিত্যিক ভাষা হিসাবে মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। 2. পালি ভাষার উৎপত্তি কীভাবে ঘটে? উত্তর : বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সংগ্রন্থনের মৌলিক প্রয়োজন থেকেই পালি ভাষার প্রথম উৎপত্তি ঘটেছে বলে সাহিত্য ঐতিহাসিকরা মনে করেছেন। 3. কোন্‌ সময়কালে সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে নানা শাস্ত্র ও কাব্যগ্রন্থ রচনার কথা জানা যায়? উত্তর : পাল রাজাদের আমলে সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বিভিন্ন শাস্ত্র এবং কাব্যগ্রন্থ রচনার সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এইসব রচনার প্রত্যক্ষ নিদর্শন অপ্রাপ্য থাকায় সাহিত্য ঐতিহাসিকরা তিব্বতি ভাষার অনুবাদ গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে থাকেন।  4. বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত সংস্কৃত সাহিত্য র...