শ্যামপণ্ডিত :-
ইনি ভণিতায় শ্রীশ্যামপণ্ডিত বলে নিজেকে উল্লেখ করেছেন। তার কাব্য 'নিরঞ্জনমঙ্গল' নামে অধিকতর পরিচিত। 'পণ্ডিত' উপাধি দেখে মনে হয়, কবি ডোমের ব্রাহ্মণ ছিলেন। কাব্যের মধ্যে দু-চারটি এমন স্থানীয় ব্যাপারের উল্লেখ আছে যে, এঁকে বীরভূমের অধিবাসী বলে মনে হয়। একখানি পুঁথিতে ১৬২৫ শকাব্দের উল্লেখ আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন, ১৭০৩-১৭০৪ খ্রীঃ অব্দে কাব্যটি সমাপ্ত হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। ভাষা দেখে তাকে বেশি পুরাতন বলে মনে হয় না। এখনও বর্ধমান অঞ্চলে ধর্মের গাজনের সময় তাঁর কাব্য পড়া হয়। তার পুঁথিগুলি খুব বিশুদ্ধ নয়, কারণ তাতে অন্য কবির ভণিতাও আছে। কবির কাব্যটি বিশেষ কোনো দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য নয়। ভাষা, কাহিনী প্রভৃতি একেবারে 'জলবত্তরলং’ ধরনের। সুতরাং এখানে এই ধরনের সাহিত্যগুণবর্জিত পুঁথি সম্বন্ধে বেশি আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।
ধর্মের ব্রত-পূজা, ধর্ম-সেবক সম্প্রদায়, ধর্মপুরাণ ও ধর্মমঙ্গলের কাহিনী এবং কবি-পরিচয় ইত্যাদি আলোচনা করে দেখা গেল, প্রাগার্য যুগ থেকে এ দেশে এই ধরনের শিলামূর্তি দেবতার পূজাদি হয়ে এসেছিল, পরে তাতে বৈদিক ও পৌরাণিক সংস্কারের পালিশ পড়ে; এতে বৌদ্ধধর্মের যৎকিঞ্চিৎ চিহ্ন যে নেই এমন মনে হয় না। রাঢ় অঞ্চলে অনুন্নত সমাজে এই দেবতার পূজাদি অনেক কাল থেকে চলে এলেও ষোড়শ শতাব্দীর আগে কোথাও ধর্মঠাকুর সংক্রাস্ত নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। মনে হয়, মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দ্বারা যখন গ্রাম্য সংস্কারের মাঝাঘ্যা চলছিল, তখনি ব্রাহ্মণ ও অন্য উচ্চবর্ণেরা ধর্মঠাকুরের মহিমার প্রতি কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হন, কেউ কেউ নিমরাজি হয়ে এই দেবতার পূজার্চনা ও মহিমা-বিষয়ক মঙ্গলকাব্য রচনায় অগ্রসর হন। তবে ধর্মপূজায় যেমন ডোম সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার, তেমনি ধর্মপুরাণ ও ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায় নিম্নবর্ণের ডোম ও ধর্মসেবক কবিদেরও বেশ যোগ দিতে দেখা যায়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই ধর্মপুরাণ ও ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলি সমাজের নীচুতলায় ও ওপরতলায় জনপ্রিয় হতে থাকে। রাঢ় অঞ্চলে এই দেবতার বিশেষ প্রভাব দেখা যায় এখনও সে প্রভাব কিছুমাত্র খর্ব হয়নি। সেদিক থেকে এই দেবতা ও মঙ্গলকাব্য সম্বন্ধে শুধু সাহিত্যের তরফ থেকে নয়, নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দিক থেকেও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। ধর্মঠাকুর, ধর্মমঙ্গল কাব্য এবং ধর্মের পূজা বিশ্লেষণ করলে এই সম্প্রদায়ের বিকাশের মূলে একটি মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যাবে। এগুলি হচ্ছে—বৈদিক আর্য, পৌরাণিক নারায়ণ, বৌদ্ধ ভাব, স্থানীয় অনার্য রীতি এবং কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ইসলামের প্রভাবও আছে। তাই বাঙালির মানসিকতায় মিশ্র সংস্কৃতির স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন