বিষয়বস্তুর প্রাচীনত্বে ও বিভিন্ন ধর্মমতের সমন্বয় প্রয়াসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন রূপে ধর্মমঙ্গল কাব্যই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মধ্যযুগীয় দৈব নির্ভরতাবাদী মঙ্গলকাব্য ধারায় ধর্মমঙ্গলের স্থান কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এই স্বাতন্ত্র্য্য মূলত ধর্মঠাকুরের স্বরূপে, ভৌগোলিক অবস্থানে এবং বিষয়বস্তুর বর্ণনা ভঙ্গিমায়। তাই এই কাব্য নিয়ে নানা দাবী উপস্থাপিত হয়েছে। এমনও দাবী করা হয়েছে যে ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য।
★ ধর্মদেবতার স্বরূপ/উদ্ভব :-
পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার অনেক গ্রামে এখনও ধর্মের থান, মন্দির ও আস্তানা আছে। বহু মন্দিরে ধর্মের কোনো মূর্তি নেই। তার শিলামূর্তি বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই মূর্তি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। সে যাই হোক, ধর্মঠাকুরের উদ্ভবের পেছনে লৌকিক ও পৌরাণিক সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। যেমন—
1. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ধর্মঠাকুর প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ দেবতা।
2. ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে—ধর্মঠাকুর বৌদ্ধ দেবতা নয়, তিনি বৈদিক সূর্য দেবতা। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সূক্তের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের সৃষ্টিতত্ত্বের গভীর সাদৃশ্য আছে।
3. সুকুমার সেনের মতে, ধর্মঠাকুর একটি মিশ্র দেবতা। বৈদিক ধর্মাচার, প্রাচীন আর্যেতর সংস্কার, ব্রাত্য শৈব ধর্ম, নাথ ধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বিষ্ণু উপাসনার সঙ্গে ধর্ম উপাসনার যোগ আছে।
4. নৃতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র রায়ের মতে, ধর্মঠাকুর প্রাক্ দ্রাবিড় যুগের দেবতা। আর্যপূর্ব অনার্য জাতির পূজিত সূর্যদেবতা কালক্রমে ধর্ম।
5. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, অষ্ট্রিক জাতির পূজিত কোন আদিম দেবতা হল এই ধর্মঠাকুর।
6. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, হিন্দু ও বৌদ্ধরা এদেশে আসবার আগে ডোমরা যে দেবতার পূজা করত সেই প্রাগার্য সূর্যদেবতা হল ধর্ম। শ্বেত রশ্মিযুক্ত সূর্যকে দরম্ বলা হয়। দরম্ থেকে ধরম্ এবং ধর্মের উৎপত্তি।
## আবার কেউ কেউ মনে করেন, বৈদিক বরুণ ও যমের সঙ্গে ডোম-চাড়াল জাতির রণদেবতা, অনার্যের শিলাদেবতা, মুসলমানের ফকির বেশধারী দেবতার প্রভাব আছে। সুতরাং ধর্মঠাকুরের উদ্ভবের পিছনে বা ধর্মের স্বরূপ নির্দেশ করতে গেলে বলা যায়—এর মধ্যে বৌদ্ধ, হিন্দু পৌরাণিক লৌকিক উপাদান মিশ্রিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন