=> রামদাস আদক:-
সপ্তদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত এই কবি গতানুগতিক পথে যৎকিঞ্চিৎ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। অধ্যাপক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রায় তেত্রিশ বৎসর পূর্বে রামদাসের *‘অনাদিমঙ্গল’* সম্পাদনা করেছিলেন। অবশ্য বসন্তকুমার রামদাস আদকের বংশধরদের মুখ থেকে শুনে কাব্যের অধিকাংশ লিখে নিয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদিত কাব্যের মূল কিন্তু কোনো পুঁথি নয়, লোকের মুখ থেকে শোনা পয়ার-ত্রিপদী। অবশ্য তিনি একখানি খাতাও উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। আধুনিক যুগের ধর্মের গায়কেরা ঐ খাতা থেকে গান গাইতেন। কাজেই রামদাস আদকের মুদ্রিত 'অনাদিমঙ্গল’ সর্বাংশে প্রাচীন কি না সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ হয়। কাব্যের প্রারম্ভে ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রথামতো কবি আত্মকথা বর্ণনা করেছেন বেশ ফলাও করে। আরামবাগের নিকটে এক গ্রামে চাষী-কৈবর্ত বংশে কবির জন্ম হয়। জমিদারের দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে তিনি যখন মাতুলালয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে বিপন্ন কবির কাছে ধর্মঠাকুর আবির্ভূত হয়ে বললেন যে, তিনি হচ্ছেন ঝাড়গ্রামের ধর্মঠাকুর কালুরায়। কবিকে তিনি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করতে আদেশ করলেন। কিন্তু কৰি যে মুর্খ।
তখন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বিষ্ণুর সমতুল্য ধর্মঠাকুর কবিকে কৃপা করলেন, দেবতার বরে মূর্খ কবি হলেন পণ্ডিত ও কবি-প্রতিভার অধিকারী। তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে এক ব্রাহ্মণ জমিদার তার জমিদারি সেরেস্তায় কবিকে উচ্চপদ দিয়েছিলেন।
রামদাসের ‘অনাদিমঙ্গলে'র কোনো কোনো পুঁথিতে যে সন-তারিখের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয় কাব্যটি ১৫৮৪ শকে বা ১৬৬২ খ্রীঃ অব্দে রচিত হয়েছিল। অবশ্য মুদ্রিত কাব্যটির কতটুকু পুঁথি থেকে নেওয়া হয়েছে, আর কতটুকু লোকের মুখ থেকে শুনে লিখে নেওয়া হয়েছে, সম্পাদক তা পরিষ্কার করে বলেননি বলে কাব্যটির গুণবিচার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু কবির ভাষা অতি পরিচ্ছন্ন, ক্লাসিক ধরনের বাঁধুনি অতি চমৎকার। মাঝে মাঝে অলংকার, শব্দযোজনা ও রূপনির্মিত রীতিমতো বিস্ময়কর শ্রীসৌষ্ঠব লাভ করেছে, যা সমসাময়িক অনেকের কাব্যেই দুর্লভ। তাই সপ্তদশ শতাব্দীর কাব্যটির প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ উকি দেয়। কেউ কেউ বলেছেন যে, রূপরামের কাব্যের সঙ্গে রামদাসের কাব্যের অনেক স্থলে গাঢ় রকমের মিল আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় রামদাস যেন রূপরামের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গিও আত্মসাৎ করেছেন। রূপরামের দ্বারা রামদাস যে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, স্থানে স্থানে তিনি অগ্রচারী কবিকে নকলও করেছিলেন, তা অস্বীকার করা যায় না। অধিকতর সুপ্রচারিত ও প্রতিভাশালী কবির দ্বারা রামদাস আদক যে স্বেচ্ছায় প্রভাবিত হয়েছিলেন এরূপ অনুমান যুক্তিসংগত। কারণ যেখানে তিনি অনুকরণ করেননি, সেখানে তার মৌলিক প্রতিভার চিহ্ন দেখা যায়। নিজের ধর্মমতেও কবির মতামত ও অভিরুচি বিশেষ প্রশংসনীয়। ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। অশিক্ষিত ও অনুন্নত কৃষকসমাজে বর্ধিত হয়েও কবি যে ধরনের রুচিজ্ঞান, পরিমাণবোধ ও সাত্ত্বিক বর্ণনা ভঙ্গিমার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাকে বিশেষ প্রশংসা করতে হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন