সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্মমঙ্গল কাব্য কে কেন রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলে অভিহিত করা হয় ??

ধর্মমঙ্গল

বিষয়বস্তুর প্রাচীনত্বে ও বিভিন্ন ধর্মমতের সমন্বয় প্রয়াসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন রূপে ধর্মমঙ্গল কাব্যই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মধ্যযুগীয় দৈব নির্ভরতাবাদী মঙ্গলকাব্য ধারায় ধর্মমঙ্গলের স্থান কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এই স্বাতন্ত্র্য্য মূলত ধর্মঠাকুরের স্বরূপে, ভৌগোলিক অবস্থানে এবং বিষয়বস্তুর বর্ণনা ভঙ্গিমায়। তাই এই কাব্য নিয়ে নানা দাবী উপস্থাপিত হয়েছে। এমনও দাবী করা হয়েছে যে ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য।

★ধর্মমঙ্গল কাব্যের ঐতিহাসিকতা :–

ধর্মমঙ্গলের কাহিনির পেছনে যে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু রয়েছে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাল বংশের সমাপ্তি পর্বকে এই কাহিনির পটভূমি হিসাবে মনে করা হয়। এই কাহিনির ইছাই ঘোষ, লাউসেন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই কাব্যে যুদ্ধ-বিগ্রহজনিত উত্তেজনামূলক ঘটনা প্রাচুর্যময় বাংলার ঘটনাকেই সূচিত করে। ধর্মঠাকুরের উৎসব কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উৎসব। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে সাধারণ বাঙালির যে মেরুদণ্ডহীন নমনীয়তা দেবতার অভিপ্রায়ের কাছে সমর্পিত হয়েছে, তার বিপরীত রূপটিই এখানে প্রকাশিত। ধর্মমঙ্গলে রাঢ়ের রাজনৈতিক জীবনযাত্রা ও তার নিম্নশ্রেণির নর-নারীর মহিমান্বিত দেশাত্মবোধের যে উজ্জ্বল রসসমৃদ্ধ চিত্র আমরা পাই তাতে একে রাঢ়ের জাতীয় কাব্য রূপে অভিহিত করা যায়।

 ★ ধর্মমঙ্গল : রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য

ধর্মমঙ্গলকে যদিও দেবমাহাত্ম্যমূলক কাব্য বলা হয়ে থাকে এবং দেবতার পূজা প্রচারের পর এই কাব্যের কাহিনির পরিসমাপ্তি হয়েছে; তথাপি এই কাব্যের ঘটনা ও কাহিনি বিশ্লেষণ করলে সেখানে মহাকাব্যের কাঠামো উপলব্ধি করা যায়। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো ধর্মমঙ্গলের উদ্দেশ্য পূজা প্রচার হলেও এতে ঘটনা-সংঘাত, বিচিত্র চরিত্রের ভীড়, শাখাকাহিনির প্রাচুর্য, অধিকাংশ চরিত্রের পূর্বজীবনের পৌরাণিক আখ্যান, ইন্দ্রিয়বিলাস, মিথ্যা ও অধর্মের পরাজয় এবং ধর্মের জয়—এত কাহিনির প্রাচুর্য আর কোন মঙ্গলকাব্যে নেই। মহাকাব্যের মূল লক্ষণগুলি হল—

১) মহাকাব্য হবে সর্গবদ্ধ কমপক্ষে আটটি সর্গে বিভক্ত হবে। 

২) ধীরোদাও গুণ সম্পন্ন দেব সভাব ব্যক্তি হবেন এর নায়ক। 

৩) ধীর, শান্ত, শৃঙ্গার এসব রসের যে কোন একটি হবে এর প্রধান রস এবং অন্যান্য যা যা করুন হাস্য বিভৎস ইত্যাদি এর আনন্দ হবে। 

৪) মহাকাব্যের প্রতিটি সর্গ শুরুতে হবে এক ছন্দে আর শেষ  হবে আর এক ছন্দে। 

৫) একটি সর্গের শেষে পরবর্তী সর্গের আভাস থাকবে।

৬) অর্থ, ধর্ম, মোক্ষ, কাম, এই চার-ই বর্গের আবশ্যক মত সমবেশ থাকবে। 

৭) শুরুতে নমস্কার, আশীর্বাদ অথবা বস্তু নির্দেশ থাকবে। 

৮) কবি বৃত্ত, নায়ক বা অন্য কোন প্রধান চরিএ অবলম্বনে নামকরণ করবেন। 

 ৯) প্রত্যেক সর্গের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ থাকবে , 

           –এমন বৈশিষ্টের কথা উল্লেক করেছেন। সাহিত্য দর্পকার বিশ্বনাথ কবিরাজ অর্থাৎ বলা যায় মহাকাব্যে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল বিস্তৃত কল্পনার বিস্তার আমাদের বিস্তারিত করে।

                   
সমগ্র ধর্মমঙ্গল.. কাহিনিতেই মহাকাব্যের কাঠামো আছে।আলোচ্য ধর্মমঙ্গল কাব্যে মহাকাব্যের বেশ কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়, সে গুলি যথাক্রমে –
  1. মনসামঙ্গলের করুণ রসে যখন বাঙালির চিত্ত আর্দ্র হয়ে গিয়েছে, বৈষ্ণব কবিতার উদ্বেল ভক্তি বিহুলতায় যখন বাঙালির চিত্ত পুরুষকারের কেন্দ্রবিন্দু হতে বিচ্যুত হয়েছে তখন সেই আর্দ্র, শৌর্যহীন, হৃদয়সর্বস্ব বাঙালিকে ধর্মমঙ্গলকারগণ এক শৌর্য ও বীরত্বের জগৎ দেখালেন।
  2. সমগ্র বাঙালি চেতনাকে এক বিরাট আলোড়ন দিয়ে ধর্মমঙ্গলকারগণ এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেছেন।
  3. এই কাব্যের চরিত্র দের কেউ কেউ এসেছেনএসেছেন স্বর্গলোক থেকে। মূল পৌরাণিক চরিত্র সৃষ্টির একটি চেষ্টা এই কাব্যে দেখা যায়। 
  4. রামায়ণ ও মহাভারতের আদর্শ রক্ষার বিশেষ চেষ্টাও এখানে রয়েছে। বিষয়টি তুলে ধরা যাতে পারে এভাবে– * লাউসেন ও কর্পূর = কখনও শ্রীরাম-লক্ষ্মণ, কখনও কৃষ্ণ-বলরাম, কখনও বা লব-কুশ। * লাউসেনের বাল্যকালের কাহিনি= শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণের বাল্যলীলার কাহিনিকে অনুসরণ করেছে।* লাউসেনের গৌড় গমনে ময়নার অবস্থা = শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমনে বৃন্দাবনের অনুরূপ।* মহামদ এবং লাউসেন = কংস ও কৃষ্ণ। * ইছাই ও লাউসেনের যুদ্ধ = রাবণ ও রামের যুদ্ধের ছায়াপাত ঘটেছে।       — এভাবে ধর্মমঙ্গল কাব্যে এসেছে জাতীয় দুই মহাকাব্য বেশ কিছু লক্ষণ।
  5. ধর্মমঙ্গলের শাখা কাহিনিগুলিও মহাকাব্যের আঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত। ধর্মমঙ্গলে দেখা যায় যে চরিত্রগুলি বর্ণিত হয়েছে সেইসব চরিত্র কোনও অভিশপ্ত চরিত্র। তারা অভিশাপ পেয়ে লাউসেনের জন্য অপেক্ষা করেছিল মুক্তি প্রত্যাশায়। এই আঙ্গিকটি পৌরাণিক মহাকাব্যের আঙ্গিক। 
  6. হরিশ্চন্দ্র পালা, কামদল বধ পালা, জামতি ও গোলাহাট পালা প্রভৃতি শাখা কাহিনিগুলি মূল কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু হতে কিছুটা বিচ্যুত হলেও এই শাখা কাহিনিগুলি থাকবার জন্য ধর্মমঙ্গল মহাকাব্যের আঙ্গিক গ্রহণ করেছে। মহাকাব্যে শাখা কাহিনি বিস্তারে পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গলও সেই মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু– 
  •  চরিত্রের মহত্ত্ব, আদর্শের সমুন্নতি, মানবমনের বিচিত্র চিত্তবৃত্তির সংঘাত এবং আদর্শ ও মহত্ত্বের জয়, আদর্শের সংঘাত এবং বহু চরিত্র ও কাহিনির বিকাশে জীবনের মহনীয় রূপের যে প্রকাশ তা ধর্মমঙ্গল কাব্যে যদিও সম্যভাবে পরিস্ফুট হয়নি,
  •   রাঢ়ভূমির কঠিন মাটির মতোই ধর্মমঙ্গলের নারীচরিত্রগুলিও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

 মূলত– 

ধর্মমঙ্গল সমসাময়িক সমাজ ও জীবনকে অতিক্রম করতে পারেনি বলে তা সার্থক মহাকাব্য হয়নি ।। [বাঃসাঃইঃ আদি ও মধ্য যুগ, ডা. দেবেশ কুমার আচার্য]

  —যদিও এই কাব্য জীবনরসে অভিষিক্ত ও এই কাব্যেই মানবজীবনের প্রতিফলন মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে নূতন রসের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপ আলোচনা করো।

  ★ধর্মমঙ্গলের কাহিনি:– ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি—হরিশ্চন্দ্র ও লাউসেনের কাহিনি।   ১. হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি:– রাজা হরিশ্চন্দ্র ও তার রানি মদনা নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজে লোকনিন্দার ভয়ে মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখেন সেখানে ধর্মঠাকুরের ভক্তেরা ঘটা করে দেবতার পূজা করছেন। রাজা ও রানি তাদের কাছে ধর্মঠাকুরের। মাহাত্ম্য শুনে ধর্মঠাকুরের পূজার্চনা করে শর্তসাপেক্ষে বর লাভ করেন। শর্ত হল এই তাদের পুত্রকে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দিতে হবে। যথাসময়ে মদনার পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাজা ও রানি পুত্রকে পেয়ে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দেওয়ার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদিন হরিশ্চন্দ্রের কাছে উপস্থিত হন। সেদিন ছিল। একাদশীর পারণ; ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র লুইধরের মাংস আহার করতে চাইলে রাজা ও রানি পুত্রকে বধ করে তার মাংস রান্না করলেন। রাজা ও রানির এই আনুগত্য ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মঠাকুর লুইধরকে জীবিত করে পুনরায় রাজা-রানির কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাজা ও রানির প্রচেষ্টায় ধর্মঠাকুরের পূজা মহাসমারোহে আয়োজিত হতে থাকে। ২. লাউসেনের কাহিনি:...

ধর্মমঙ্গল কাব্যের অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দাও।।।।

         ■ অষ্টাদশ শতাব্দী – শ্রেষ্ঠ কবি                    • ঘনরাম চক্রবর্তী ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম অষ্টাদশ শতাব্দীর শক্তিমান কবি। মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্যযুগের শেষ পর্যায়ে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল এবং ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল নির্বাণোন্মুখ দীপশিখার মতো সর্বশেষ জ্যোতি।  সুকুমার সেন লিখেছেন,– “ধর্মমঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত ও দক্ষ ছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম সুলেখক ছিলেন। তাঁহার রচনা সর্বাধিক পরিচিত ধর্মমঙ্গল কাব্য”। ( বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫১ )।  অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন, –“আধুনিক যুগের বাঙালী সমাজ তাঁহার কাব্য হইতেই ধর্মমঙ্গল কাব্যের নূতনত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন। এই শাখার অন্যান্য শক্তিশালী কবি অপেক্ষা ঘনরাম অধিকতর ভাগ্যবান। কারণ ধর্মমঙ্গলের কবিদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মার্জিত রুচির নাগরিক সমাজে পরিচিত হন। ( বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-৯৮ ...

বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা এবং বিবর্তনের ইতিহাস। সমস্ত সংক্ষিপ্ত ও অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ....

সংক্ষিপ্ত ও অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ....                                                  প্রতিটি প্রশ্নের মান ১/২ 1. ভারতবর্ষের প্রথম সাহিত্যিক ভাষারূপে কোন ভাষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে? উত্তর : আনুমানিক খ্রিঃ পূর্বঃ ৬০০-২০০ খ্রিঃ মধ্যে প্রচলিত 'পালি' ভাষাকে লোক ভারতের প্রথম সাহিত্যিক ভাষা হিসাবে মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। 2. পালি ভাষার উৎপত্তি কীভাবে ঘটে? উত্তর : বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সংগ্রন্থনের মৌলিক প্রয়োজন থেকেই পালি ভাষার প্রথম উৎপত্তি ঘটেছে বলে সাহিত্য ঐতিহাসিকরা মনে করেছেন। 3. কোন্‌ সময়কালে সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে নানা শাস্ত্র ও কাব্যগ্রন্থ রচনার কথা জানা যায়? উত্তর : পাল রাজাদের আমলে সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বিভিন্ন শাস্ত্র এবং কাব্যগ্রন্থ রচনার সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এইসব রচনার প্রত্যক্ষ নিদর্শন অপ্রাপ্য থাকায় সাহিত্য ঐতিহাসিকরা তিব্বতি ভাষার অনুবাদ গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে থাকেন।  4. বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত সংস্কৃত সাহিত্য র...