ধর্মমঙ্গল
★ধর্মমঙ্গল কাব্যের ঐতিহাসিকতা :–
ধর্মমঙ্গলের কাহিনির পেছনে যে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু রয়েছে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাল বংশের সমাপ্তি পর্বকে এই কাহিনির পটভূমি হিসাবে মনে করা হয়। এই কাহিনির ইছাই ঘোষ, লাউসেন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই কাব্যে যুদ্ধ-বিগ্রহজনিত উত্তেজনামূলক ঘটনা প্রাচুর্যময় বাংলার ঘটনাকেই সূচিত করে। ধর্মঠাকুরের উৎসব কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উৎসব। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে সাধারণ বাঙালির যে মেরুদণ্ডহীন নমনীয়তা দেবতার অভিপ্রায়ের কাছে সমর্পিত হয়েছে, তার বিপরীত রূপটিই এখানে প্রকাশিত। ধর্মমঙ্গলে রাঢ়ের রাজনৈতিক জীবনযাত্রা ও তার নিম্নশ্রেণির নর-নারীর মহিমান্বিত দেশাত্মবোধের যে উজ্জ্বল রসসমৃদ্ধ চিত্র আমরা পাই তাতে একে রাঢ়ের জাতীয় কাব্য রূপে অভিহিত করা যায়।
★ ধর্মমঙ্গল : রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য
- মনসামঙ্গলের করুণ রসে যখন বাঙালির চিত্ত আর্দ্র হয়ে গিয়েছে, বৈষ্ণব কবিতার উদ্বেল ভক্তি বিহুলতায় যখন বাঙালির চিত্ত পুরুষকারের কেন্দ্রবিন্দু হতে বিচ্যুত হয়েছে তখন সেই আর্দ্র, শৌর্যহীন, হৃদয়সর্বস্ব বাঙালিকে ধর্মমঙ্গলকারগণ এক শৌর্য ও বীরত্বের জগৎ দেখালেন।
- সমগ্র বাঙালি চেতনাকে এক বিরাট আলোড়ন দিয়ে ধর্মমঙ্গলকারগণ এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেছেন।
- এই কাব্যের চরিত্র দের কেউ কেউ এসেছেনএসেছেন স্বর্গলোক থেকে। মূল পৌরাণিক চরিত্র সৃষ্টির একটি চেষ্টা এই কাব্যে দেখা যায়।
- রামায়ণ ও মহাভারতের আদর্শ রক্ষার বিশেষ চেষ্টাও এখানে রয়েছে। বিষয়টি তুলে ধরা যাতে পারে এভাবে– * লাউসেন ও কর্পূর = কখনও শ্রীরাম-লক্ষ্মণ, কখনও কৃষ্ণ-বলরাম, কখনও বা লব-কুশ। * লাউসেনের বাল্যকালের কাহিনি= শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণের বাল্যলীলার কাহিনিকে অনুসরণ করেছে।* লাউসেনের গৌড় গমনে ময়নার অবস্থা = শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমনে বৃন্দাবনের অনুরূপ।* মহামদ এবং লাউসেন = কংস ও কৃষ্ণ। * ইছাই ও লাউসেনের যুদ্ধ = রাবণ ও রামের যুদ্ধের ছায়াপাত ঘটেছে। — এভাবে ধর্মমঙ্গল কাব্যে এসেছে জাতীয় দুই মহাকাব্য বেশ কিছু লক্ষণ।
- ধর্মমঙ্গলের শাখা কাহিনিগুলিও মহাকাব্যের আঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত। ধর্মমঙ্গলে দেখা যায় যে চরিত্রগুলি বর্ণিত হয়েছে সেইসব চরিত্র কোনও অভিশপ্ত চরিত্র। তারা অভিশাপ পেয়ে লাউসেনের জন্য অপেক্ষা করেছিল মুক্তি প্রত্যাশায়। এই আঙ্গিকটি পৌরাণিক মহাকাব্যের আঙ্গিক।
- হরিশ্চন্দ্র পালা, কামদল বধ পালা, জামতি ও গোলাহাট পালা প্রভৃতি শাখা কাহিনিগুলি মূল কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু হতে কিছুটা বিচ্যুত হলেও এই শাখা কাহিনিগুলি থাকবার জন্য ধর্মমঙ্গল মহাকাব্যের আঙ্গিক গ্রহণ করেছে। মহাকাব্যে শাখা কাহিনি বিস্তারে পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গলও সেই মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু–
- চরিত্রের মহত্ত্ব, আদর্শের সমুন্নতি, মানবমনের বিচিত্র চিত্তবৃত্তির সংঘাত এবং আদর্শ ও মহত্ত্বের জয়, আদর্শের সংঘাত এবং বহু চরিত্র ও কাহিনির বিকাশে জীবনের মহনীয় রূপের যে প্রকাশ তা ধর্মমঙ্গল কাব্যে যদিও সম্যভাবে পরিস্ফুট হয়নি,
- রাঢ়ভূমির কঠিন মাটির মতোই ধর্মমঙ্গলের নারীচরিত্রগুলিও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
মূলত–
ধর্মমঙ্গল সমসাময়িক সমাজ ও জীবনকে অতিক্রম করতে পারেনি বলে তা সার্থক মহাকাব্য হয়নি ।। [বাঃসাঃইঃ আদি ও মধ্য যুগ, ডা. দেবেশ কুমার আচার্য]
—যদিও এই কাব্য জীবনরসে অভিষিক্ত ও এই কাব্যেই মানবজীবনের প্রতিফলন মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে নূতন রসের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন