★ ধর্মমঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্যঃ–
মঙ্গলকাব্য ধারায় ধর্মমঙ্গলের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ করার মতো।
* সাদৃশ্য–
১. মঙ্গলকাব্য সমূহের ধারা অনুসারে এই কাব্যের নামকরণ ধর্মমঙ্গল এবং এই কাব্যে দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারই মঙ্গলকাব্যের স্বরূপকে ফুটিয়ে তোলে।
২. অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে নায়ক চরিত্রের দৃঢ়তার প্রকাশ এখানে বর্তমান।
৩. রচনাংশে কবির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক পদ এবং সমাপ্তিতে দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের পর নায়ক-নায়িকার স্বর্গারোহণ মঙ্গলকাব্যের ধারার মতো এখানেও অনুসৃত হয়েছে।
৪. বিভিন্ন লৌকিক বর্ণনা, সমাজ মানসিকতার পরিচয়, রাজানুগ্রহ, স্বপ্নাদেশ, পালাবদ্ধ গীত রচনা প্রভৃতি দিক থেকে মঙ্গলকাব্যের ধারার সঙ্গে এই কাব্যের নিগূঢ় যোগ রয়েছে।
*বৈসাদৃশ্য–
১. ধর্মঠাকুর হল পুরুষ দেবতা। কিন্তু চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গলে স্ত্রী দেবতা।
২. চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল বৃহৎ বঙ্গে প্রচলিত থাকলেও ধর্মমঙ্গল শুধুমাত্র রাঢ় অঞ্চলের কাব্য।
৩. আর কোনো দেবতার পূজায় জাতিভেদ বিড়ম্বিত হিন্দু সমাজ এত ভেদবুদ্ধিহীন সর্বজনীন ভক্তির আশ্রয়ে ঐক্যের স্ফূরণ অনুভব করেনি। আর কোন দেবতার পূজায় এমন হাতে-নাতে ফল পায়নি। আর কোন পূজায় ভক্তদের নেশাহীন বিশ্বাসের সঞ্চার হয়নি। কাজেই ধর্মঠাকুরের প্রভাব প্রতিপত্তি যে অন্যান্য লৌকিক দেবদেবীর পরোক্ষ আহ্বান ও বিলম্বিত বিপদমুক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মর্যাদা অপেক্ষা বেশি সজীব ও সক্রিয় ছিল তা বোঝা যায়।
৪. ধর্মমঙ্গলের কাহিনিতে অনেক কাল্পনিক গল্প আখ্যান থাকলেও এর পটভূমিকায় প্রাচীন গৌড়দেশের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। বিষয়বস্তুর প্রাচীনত্বে মঙ্গলকাব্য সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এই কাব্যে বর্ণিত ঘটনাগুলি খ্রিস্টীয় দশম শতকের বলে মনে হয়। লাউসেন, ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক চরিত্র।
৫. অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো ধর্মমঙ্গল কাব্যেও যুদ্ধের বর্ণনা আছে। কিন্তু সেইসব যুদ্ধ অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো নেপথ্যবাসিনী মহামায়ার অদৃশ্য উপস্থিতিতে ঘটেনি, তা ঘটেছে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ ঘটনার সন্নিবেশে। তাই ধর্মমঙ্গল কাব্যে যুদ্ধগুলি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক প্রয়োজন ও মানবিক বৃত্তি সঞ্জাত সামন্তরাজ কর্ণসেনের ছয় পুত্র একটি যুদ্ধে নিহত হয়। ছয় পুত্রবধূ সহমৃতা হন। রানি দুঃখে আত্মঘাতী হন এবং বৃদ্ধ রাজার অস্তিম জীবনে নিঃসঙ্গতার বেদনা ঘনীভূত হয়। এই ঘটনা মনসামঙ্গলে লক্ষ করা যায় না। সুতরাং নির্মম, সান্ত্বনাহীন, ভাগ্য বিড়ম্বনার উদাহরণ ধর্মমঙ্গলের কাহিনিতে যেভাবে দেখা যায় তা অন্য কোথাও দেখা যায় না।
৬. এই কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত অর্বাচীনকালে।
৭. অন্যান্য কাব্যের নায়ক নায়িকার আবির্ভাব অভিশপ্তীয় রীতিতে। কিন্তু এ কাব্যে কোন স্পষ্ট নির্দেশ নেই।
৮. দেবখণ্ড ও নরখণ্ডের মধ্যে স্পষ্টত কোনো বিভাগ এখানে লক্ষ করা যায় না। তাছাড়া ধর্মমঙ্গলের কাহিনি বার-টি পালায় (মতি’) বিভক্ত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন