কবি যদুনাথ (যাদবনাথ) –সপ্তাদশ শতাব্দীর বা উত্তর-চৈতন্য যুগ-এর ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি –সংক্ষিপ্ত পরিচয় ।।
যদুনাথ (যাদবনাথ) :–
কিছুকাল পূর্বে বিশ্বভারতী থেকে ড. পঞ্চানন মণ্ডলের সম্পাদনায় আর একখানি নতুন ধর্মমঙ্গল কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। কবির নাম যদুনাথ বা যাদবনাথ। মনে হয় ইনি হাওড়া জেলার লোক, কারণ পুঁথিটি হাওড়া জেলার একটি গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে। সৌভাগ্যের বিষয় পুঁথিটি অখণ্ডিত ও সম্পূর্ণ।
কাব্যের মধ্যে কবি নিজের সম্বন্ধে যে যৎসামান্য ইঙ্গিত দিয়েছেন তা থেকে দেখা যাচ্ছে, শোভা সিং নামে এক বিদ্রোহী দুর্দান্ত জমিদার বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরামকে নিহত করে তার কন্যার ওপর অত্যাচার করতে গিয়ে সেই রাজকুমারীর ছুরিকাঘাতে ভবলীলা সাঙ্গ করে—এটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ঘটনা।
কবি রাজা কৃষ্ণরামের সেই হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করে বলেছেন, “সেইকালে গীত সাঙ্গ হইল আমার।” ১৬৯৬ খ্রীঃ অব্দে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যদুনাথ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধর্ম মঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন। অবশ্য নিজের কাব্যকে কবি সর্বত্র *‘আগমপুরাণ’* বলেছেন।
কবি ধর্মঠাকুরের মহিমা লিখতে বসলেও বৈষ্ণব ও শাক্তমতের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। খুব সংযত ও মার্জিত ভাষায় রচিত ‘আগমপুরাণে’ কবি শুধু রামাই পণ্ডিত ও হরিশচন্দ্র-লুইচন্দ্রের কাহিনী বলেছেন, লাউসেনের কোনো উল্লেখ করেননি।
ধর্ম-উপাসকেরা আগমপুরাণে শুধু হরিশ্চন্দ্র রাজার কাহিনী এবং কোনো কোনো সময়ে তার সঙ্গে রামাই পণ্ডিতের জীবন কথাও বলতেন। কিন্তু ধর্মমঙ্গলে লাউসেনের কাহিনী সবিস্তার বর্ণিত হত। যদুনাথের কাব্য ধর্মপুরাণ বা আগমপুরাণ— এ ঠিক আসলে ধর্মমঙ্গল কাব্য নয়। এতে কবি হিন্দুর বিভিন্ন সম্প্রদায়, এমনকি মুসলমান পীরফকিরের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। কাহিনীতে হরিশ্চন্দ্রের প্রথম দিকে ধর্ম বিরোধিতা, পরে শক্তির আরাধনা করে ধর্মের কৃপায় পুত্রলাভের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং তার পরের গল্প অন্যান্য ধর্মপুরাণ বা আগমপুরাণের মতো। কাহিনীটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন।
রানীমদনার মাতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতাও বেশ ফুটেছে। কবি তাতি বা যুগী—যে সম্প্রদায়ভুক্ত হন না কেন, এ-কাব্যে পুরাণজ্ঞান ও সংযত রচনার ভালো পরিচয় দিয়েছেন। ব্যক্তিগত ধর্মমতের দিক থেকে তিনি বোধ হয় চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন। কারণ কাব্যের নানাস্থানে সেই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য কাব্যটি বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল বলে মনে হয় না, এর একাধিক পুঁথিও পাওয়া যায়নি। লোকচিত্তরঞ্জক উদ্ভট বর্ণনা পরিত্যাগ করে যদুনাথ এমন একটি শান্ত সংযত বর্ণনাভঙ্গি অবলম্বন করেছিলেন যা সাধারণ সমাজে হয়তো গৃহীত হয়নি। তা নাই হোক, এ যুগের রসিক পাঠক কবিকে নিশ্চয় প্রশংসা করবেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন