উওর :-
বিজ্ঞান বলতে বিশেষ এক ধরনের জ্ঞানকে বোঝায়। এই জ্ঞান অর্জনের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে যেমন, প্রমাণ সাপেক্ষে বক্তব্য রাখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধান্তকে যাচাই করা গ্রহণ করা বা বর্জন করা। প্রাণীবিদ্যা, রসায়ন, অর্থনীতি এইসব বিষয়ের বৈজ্ঞানিক চরিত্র তাদের সুসংগঠিত জ্ঞান প্রকাশের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। এইভাবে দেখলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে অনেক আলোচনা আছে যেখানে বিজ্ঞানের চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করে বিষয়-বিশ্লেষণ ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা হয়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় নির্বাচনের সময় ভোটদানের প্রকৃতি কী হবে (কে কাকে ভোট দেবে), প্রতিযোগী দলগুলির ভোটের হার কেমন হতে পারে, এই নিয়ে পরিসংখ্যানভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রায়ই করে থাকেন। জনমত নিয়েও বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা হয়। যেমন, জনগণ সরকারের একটি নীতিকে সমর্থন করে কি করে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ পদ্ধতি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। তার দু-একটি কারণ বলা যেতে পারে। যেমন, প্রথমত, পরীক্ষাগারে একজন রসায়নশাস্ত্রের বিজ্ঞানী যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সেইভাবে রাজনীতির ঘটনাকে কৃত্রিমভাবে তুলে নিয়ে এসে বারংবার বিশ্লেষণ করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, ধরা যাক, একটি অরণ্যে গাছপালা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথবা দেশের একটি অঞ্চলে তীব্র অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দিয়েছে এই ধরনের ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। কিন্তু, পাকিস্তানে সামরিক শাসন কেমন করে হল, এর একটিমাত্র সহজ ব্যাখ্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সহজে দিতে সমর্থ হন না। অর্থাৎ সামাজিক ঘটনার পিছনে অজস্র সম্ভাব্য কারণ থাকে। সমাজবিজ্ঞানী এই জটিলতা ভেদ করে সত্যের আলো ফেলার চেষ্টা করেন নিশ্চয়, তবে অসংখ্য উপাদানের মধ্যে গ্রহণ-বর্জনের পদ্ধতি সহজ নয়। ফলে, নির্দিষ্ট কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর একটি কথা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সমাজভিত্তিক মানুষ। মানুষের ব্যবহার নিয়ে মনস্তত্ব বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করলেও নিশ্চয় করে বলা কঠিন কে কখন কীভাবে ব্যবহার করবে। ভোটের দিনে মনে করা হল সত্তর শতাংশ ভোট পড়বে। হঠাৎ এমন হতেও পারে যে বেশকিছু সংখ্যক ভোটার কোনো না কোনো কারণে ভোট দিতে এলেন না। আরও মনে রাখতে হবে যে, অন্য বিজ্ঞানীদের দ্রষ্টব্য বিষয় যেমন, পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, বৃষ্টি, গাছপালা, পশুপ্রাণী ইত্যাদি বস্তুজগতে নির্দিষ্টভাবে আছে। বিজ্ঞানী এইসব বস্তু থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে, কিন্তু, দ্রষ্টব্যবিষয়ের মধ্যেই বিজ্ঞানী রয়ে গেছেন। তিনি যেভাবে দেখবেন সেই দৃষ্টিভঙ্গীও তার অনুসন্ধানের অঙ্গ হয়ে যায়। আবার বিজ্ঞানীর নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ, তার নিজের ভালমন্দর ধারণা তার বৈজ্ঞানিক চিন্তার উপর প্রভাববিস্তার করতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার একটি বড় অংশ মূল্যবোধ-সংক্রান্ত। ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি আলোচনার প্রকৃতিই স্বতন্ত্র। ইতিহাস, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র—এইসবের জ্ঞানের আলোতে মূল্যবোধের সুক্ষ্ম আলোচনা (যা স্বভাবতই বিতর্কিত) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বহুপ্রচলিত ধারা। প্রকৃতিবিজ্ঞানীর বন্ধনির্ভর গবেষণা পদ্ধতি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না।
এই আলোচনা থেকে বলা যায় কিছু কিছু বিষয় (যেমন, নির্বাচনী বিশ্লেষণ) প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়মে ও পদ্ধতিতে আলোচনা সম্ভব এবং তা করা হয়েও থাকে। বিজ্ঞানের যে গুছিয়ে জ্ঞান আহরণ ও প্রকাশের দিক আছে সেদিক থেকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু, আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিষয়বস্তু অভিন্ন। বিশেষ করে মানুষকেন্দ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান আবার তার নিজস্ব পদ্ধতিতে অনেক বিষয় আলোচনা করে থাকে। এর ফলে তার বিজ্ঞানীচরিত্র বিঘ্নিত হয় না। মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিশেষ ধরনের সমাজবিজ্ঞান এবং এর নিজস্ব জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া আছে এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানীর পদ্ধতিই একমাত্র জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি, একথা মেনে নেওয়া হয় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন