সপ্তাদশ শতাব্দীর বা উত্তর-চৈতন্য যুগ-এর ধর্মমঙ্গল কাব্যের কয়েকজন কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।।
উঃ-
● মানিকরাম গাঙ্গুলি :–
ইনি ধর্মমঙ্গলের বিশিষ্ট কবি হলেও এঁর আবির্ভাবকাল, গ্রন্থ রচনার সন তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে পণ্ডিতদের অনুমান অষ্টাদশ শতাব্দীতে মানিকরাম কাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর কাব্যের নাম 'শ্রীধর্মমঙ্গল' বা 'বার্মাতি। কবি পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারত থেকে কাহিনি সংগ্রহ করেছেন। আদিরসের বাড়াবাড়ি থাকলেও রঞ্জাবতীর মাতৃহৃদয়ের ব্যথা-বেদনা বেশ সহৃদয়তার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর কাব্যের বাস্তবতা প্রশংসনীয়।
• রামদাস আদক : –
রামদাসের কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল'। ইনি সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। তার কাব্যে গ্রথিত আত্মবিবরণী থেকে জানা যায় ভুরসুট পরগনার রাজা প্রতাপনারায়ণের (কবি ভারতচন্দ্রের পূর্বপুরুষ) রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত আরামবাগের কাছাকাছি হায়াপুর গ্রামে কবি রামদাসের জন্ম। কবি জাতিতে কৈবর্ত হলেও পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী। ১৫৮৪ শকাব্দে বা ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে কবির কাব্য সমাপ্ত হয়। কবির কবিত্বশক্তি প্রশংসনীয়। কাহিনি বয়নে, চরিত্র সৃষ্টিতে রচনা কৌশলের আধুনিকতায়, পৌরাণিক প্রসঙ্গের বর্ণনায় ও মার্জিত রুচির পরিচয়দানে কবি রামদাসের কৃতিত্ব যথেষ্ট। তার কাব্যের বাগ্রীতি বেশ উজ্জ্বল। যেমন –
যুবক স্বামীর কথা পীযুষের কণ।
বৃদ্ধ সোয়ামীর কথা ছেঁচা ঘায়ে নুন৷৷
• সীতারাম দাস :-
অষ্টাদশ শতকের ধর্মমঙ্গল ধারার আর এক কবি হলেন সীতারাম দাস। কবির আত্মজীবনী থেকে জানা যায় কবির পৈতৃক বাড়ি বর্ধমান জেলার খণ্ডকোষের অন্তর্গত সুখসাগর গ্রামে। তবে কবির জন্মস্থান মাতুলালয় বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস গ্রামে। ইন্দাস গ্রামের পুরোহিত নারায়ণ পণ্ডিতের উৎসাহে কবি কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্য রচনাকাল ১৬৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ।
সীতারাম কাব্যের মধ্যে বিশেষ কোন নতুনত্ব দেখাতে না পারলেও কাহিনি বর্ণনায় সহজ সরল সাবলীলতাকে অবলম্বন করেছেন। যেমন, বৈশাখ মধ্যাহ্নে বনের পৌভার মনোরম বর্ণনা–
বৈশাখ সময় তার কুড়চির ফুল।
ঝুপঝুপ ফুল খসে বাতাসে আকুল।।
কাত কাত কাননে হরিণী কালসার।
ক্ষণেক দিবস হয় ক্ষণেক আঁধার।।
• ময়ূরভট্ট :–
ময়ূরভট্টের ধর্মমঙ্গল কাব্য পাওয়া না গেলেও ধর্মমঙ্গল কাব্যের বহু কবি তাঁকে ধর্মমঙ্গলের আদি কবি বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন—মানিক গাঙ্গুলি লিখেছেন-
বন্দিয়া ময়ূরভট্ট কবি সুকোমল।
দ্বিজ শ্রীমাণিক ভণে শ্রীধর্মমঙ্গল৷৷
ধর্মমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তীও লিখেছেন, ‘ময়ূরভট্টে বন্দিব সঙ্গীত আদ্যকবি।'
বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ময়ূরভট্টের রচিত ‘শ্রীধর্মপুরাণ’ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সুকুমার সেনের মতে গ্রন্থটি রামচন্দ্র বাঁড়ুজ্যের রচনা।
• রূপরাম চক্রবর্তী :–
ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ময়ূরভট্ট হলেও প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি হলেন রূপরাম চক্রবর্তী। তাঁর কাব্যের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে লাউসেনের জন্ম থেকে আখড়ায় মল্লবিদ্যা শিক্ষা পর্যন্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
সুকুমার সেনের মতে রূপরাম ধর্মমঙ্গলের প্রথম কবি। তাঁর কাব্য রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কে কাব্য রচনাকাল হিসাবে সমালোচকরা মনে করেন। তবে ষোড়শ শতকের শেষভাগে কিম্বা সপ্তদশ শতকের প্রথমে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়— বর্ধমানের রায়না থানার অন্তর্গত শ্রীরামপুরের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। কবি বাল্যকাল থেকে পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন, সেজন্য অভিভাবকের কাছে তিরস্থত হতেন। তারপর বাড়ি ছেড়ে এক টোলে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে একদিন অনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাঘ্ররূপী ধর্মঠাকুরের সঙ্গে কবির দেখা হয় এবং ঠাকুর তাক কাব্যরচনার নির্দেশ দিয়ে আশীর্বাদ করেন।রূপরামের কাব্যের নাম অনাদিমঙ্গল (অনাদ্যমঙ্গল)। তাঁর কাব্যের সম্পর্কিত যে শ্লোকটি পাওয়া যায় তা হল–
তিন বাণ চারি যুগে বেদে যত রয়
শাকে সনে জড় হৈলে কত শক হয়।
রসের উপরে রস তাহে রস দেহ।
এই শকে গীত হৈল লেখা কইরা লেহ।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন